Header Ads

পুতুলতন্ত্র || প্রবীর মজুমদার || মিডনাইট হরর স্টেশন

 

 
 

পুতুলতন্ত্র

প্রবীর মজুমদার

 

মাস তিনেক পরেই সাধারণ নির্বাচন। এক নবাগত রাজনৈতিক দল নির্বাচনী প্রচারের উদ্যেশ্যে দলের নাম ও চিহ্ন অঙ্কিত টি-শার্ট বিলি করবে। ১ লাখ টি-শার্টের বরাত পেয়েছে আমাদের সংস্থা সৃজা হোসিয়ারি। কাজ কেমন চলছে তা সরেজমিনে দেখার জন্যে ওই দলের পক্ষ থেকে প্রচার সচিব বরেন মোহন্ত এসেছিলেন। টিশার্টের ডিজাইনে কিছু মডিফিকেশন করার প্রস্তাবও ছিল তাঁর। এই ব্যাপারেই মালিক হরমোহনবাবুর সঙ্গে তাঁর জরুরি মিটিং হবার কথা ছিল। কিন্তু বরেনবাবুর আসার খবর হরমোহনবাবুকে জানাতেই তিনি বললেন, 'আজ আর কারো সাথে দেখা করার ইচ্ছে নেই। তুমিই যা ভাল বোঝ করো।" অগত্যা আমাকেই ক্লায়েন্ট সামলাতে হল। কাজ সমাধা হবার পর হরমোহনবাবুকে রিপোর্ট করতে গিয়ে দেখি তিনি অন্যমনস্ক হয়ে চেম্বারে পায়চারি করছেন। এটা তাঁর উদ্বেগের লক্ষণ। হরমোহনবাবুকে তো অল্প দিন চিনি না, আর সম্পর্কটাও বেশ মধুর ও গভীর, তাই তাঁর হাবভাব বুঝতে কষ্ট হয় না আমার। ম্যানেজার হিসেবে কর্তার মানসিকতা বুঝেই আমাকে চলতে হয়।
'সমস্যাটা কী, আমাকে কি বলা যায়?' হরমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম।
চমকে উঠে তিনি আমাকে দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বললেন, 'ওহ্ তুমি! তারপর বলো ওদিকের খবর কী?'
বললাম, 'ওদিকের খবর তো ভালই, ডিজাইন মডিফিকেশনের জন্যে বরেনবাবু এক্সট্রা পেমেন্ট করতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু আপনি ব্যস্ত থাকলে সেসব এখন বরং থাক। আমি না হয় পরে আসব।'
'কিসের ব্যস্ততা? তোমার উপর ম্যানেজারির দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চন্তে আছি হে!'
'কিন্তু আপনাকে দেখে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে... দুশ্চিন্তার কারণটা জানতে পারি কি?'
হরমোহনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ধীরে ধীরে রিভলভিং চেয়ারটায় বসে বললেন, 'নেহাতই শুনবে? নাহ্, থাক! ব্যাপারটা শুনে তুমি হয়ত হাসবে, হয়ত মনে মনে বলবে-- বুড়োটার ভীমরতি হয়েছে!'
'কী যে বলেন স্যার! সমস্যাটা কী, তা জানতে পারলে সমাধানের চেষ্টা করার সুযোগ পেতে পারি... এই আর কী!'
হরমোহনবাবু কয়েক সেকেন্ড সিলিং-এর দিকে চেয়ে কী যেন ভাবলেন, তারপর টেবিলের উপরে রাখা পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দেওয়া খবরের কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, 'সেকেন্ড পেইজ দেখো।'
খবরের কাগজ আনফোল্ড করে সেকেন্ড পেইজ মেলে ধরতেই গাদাগুচ্ছের বিজ্ঞাপন আর দৈনিক রাশিফল চোখে পড়ল। ভাবলাম হরমোহনবাবু বোধহয় রাশিফলই দেখতে বলছেন— এমন কিছু হয়ত তাঁর রাশিফলে লেখা আছে, যা তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার এই রকম ধারণা বিনা কারণে নয়। জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর হরমোহনবাবুর অগাধ আস্থা। ভাল জ্যোতিষির খবর পেলেই তিনি তাঁকে দিয়ে ভাগ্যগননা করাবার সুযোগ হাতছাড়া করেন না। জ্যোতিষিরাও শাঁসালো মক্কেল পেয়ে গ্রহরত্ন না গছিয়ে ছাড়ে না।  ফলে এখন এমন হয়েছে যে, দুই হাতে এমন কোনও আঙুল নেই যাতে একাধিক আংটি নেই। আঙুলে জায়গা না থাকার কারণে এখন গ্রহরত্ন দিয়ে হার বানিয়ে ধারণ করতে হচ্ছে। ব্যবসা যত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঈশ্বর-ভক্তি, বাড়ছে ভাগ্যফলপ্রিয়তা।  পঞ্জিকা না দেখে তিনি কোনও ডিলের মধ্যে থাকেন না। বরেন মোহন্তবাবুর সঙ্গে আজকের যে মিটিং ছিল, তার দিনক্ষণও ঠিক হয়েছিল ঐ পঞ্জিকা দেখে-ই।
হরমোহনবাবুর রাশি হল কুম্ভ। সুতরাং খবরের কাগজে কুম্ভ রাশিতে যা লেখা আছে তা সশব্দে পড়তে শুরু করলাম, 'অতিরিক্ত কাজের ফলে শারীরিক রোগ বৃদ্ধি। ইচ্ছাপূরণে বাধা। বেলার দিকে শুভ। বন্ধুকে অযথা বিশ্বাস করে ঠকতে...'
'থাম, থাম ওসব কী পড়ছ?' হরমোহনবাবু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, 'দাও পেপারটা দাও।'
হরমোহনবাবু আমার হাত থেকে কাগজটা এক রকম ছিনিয়েই নিলেন। তারপর কাগজটা টেবিলের উপর মেলে ধরে একটা বিজ্ঞাপনের উপর আঙুল রেখে বললেন, 'এই বিজ্ঞাপনটা দেখ। এখানে লেখা রয়েছে, "পুতুলতন্ত্র দ্বারা সমস্যার সমাধান করা হয়"। এই কথার মানে কী?'
'পুতুলতন্ত্র? পুতুলে সূচ ফুটিয়ে শত্রু-নিধনের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।'
টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে বিজ্ঞাপনটা ভাল করে দেখলাম। এক জ্যোতিষির সচিত্র বিজ্ঞাপন। তান্ত্রিক জ্যোতিষি শ্রী বিশ্বামিত্র শাস্ত্রী, গোল্ড মেডালিস্ট। বিবাহ, চাকুরি, আইন-আদালত -- যে কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান। পুতুল তন্ত্রে সিদ্ধহস্ত। বিফলে মূল্য ফেরত।
'আপনি কি এই জ্যোতিষি ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে চান? এপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করব না কি?'
'তার আর দরকার নেই। সামনের মাসে মেয়ের জন্মদিন আছে না? উপহার দেব বলে জুয়েলারি শপে গিয়েছিলাম। ওখানে জ্যোতিষির চেম্বারে নতুন নেমপ্লেট দেখে ঢুকে পড়লাম। ঢুকেই হতভম্ভ হয়ে গেলাম। আমার তখন ন যযৌ ন স্থতৌ অবস্থা! লম্বা জটাজুটো, একমুখ দাড়ি, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা থাকা সত্ত্বেও জ্যোতিষিকে চিনতে সমস্যা হল না। বিশ্বামিত্র শাস্ত্রীর আসল নাম যামিনীমোহন সেন।'
'যামিনীমোহন? আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র?' বিষ্মিত হয়ে বললাম, 'সে নিখোঁজ হয়েছিল না?'
'দেশান্তরী হয়েছিল। শুনেছিলাম হরিদ্বারে গিয়ে সন্যাসী হয়েছিল। তারপর আর কোনও খবর পাইনি। কম দিন তো নয়, সাত-আট বছর তো হবেই। আমাকে দেখে নেবার হুমকি দিয়েছিল বলে বহুদিন টেনশনে থাকতে হয়েছে আমার। মনে হতো এই বুঝি যামিনী হঠাৎ ফিরে এসে আমার কোনও অনিষ্ট করে। ওকে খুঁজে বের করার জন্যে গোয়েন্দাও লাগিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কিছু আর্থিক সাহায্য করে তার ক্ষোভ প্রশমণ করব। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। এতদিন পর ওকে জ্যোতিষির বেশে দেখতে হল! তাও যে সে জ্যোতিষি নয়, তন্ত্রসাধক জ্যোতিষি।' দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হরমোহনবাবু।
'যামিনীমোহনবাবু কি নতুন করে আবার হুমকি-টুমকি দিয়েছে না কি?'
'তা একরকম হুমকিই বলা যায়। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যা বলেছে, তাতে আমার যথেষ্টই দুশ্চিন্তার কারণ আছে হে! ও বলল, বহুদিন আগে আমি যার ক্ষতি করেছি সে খুব শিগগিরই প্রতিশোধ নেবে।'
'যামিনীমোহনবাবু আপনাকে চিনেছে?'
'দরজা ঠেলে যখন ঢুকলাম, মনে হল জ্যোতিষি ভদ্রলোক যেন আমাকে দেখেই কেমন চমকে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। পুরো সময়টাই অচেনার ভান করে কাটিয়ে দিল। ওকে আমি ঠিক চিনেছি। কিন্তু ও যখন আমাকে না চেনার ভান করল, তখন আমিই-বা আর খুঁচিয়ে ঘা কেন করব? আমি যে ওকে চিনতে পেরেছি, তা আর প্রকাশ করলাম না। হাত দেখিয়ে যখন বেরিয়ে আসব, তখন যামিনী আমাকে পিছু ডাকল। বলল, "আপনি তো ব্যবসা করেন, সুতরাং পেশাগত শত্রুর অভাব থাকার কথা নয়। আমি এই ধরণের সমস্যারও সমাধান করি। যদি লাগে তো বলবেন। ভুডু পুতুল দেখেছেন? দাঁড়ান দেখাচ্ছি।" এই বলে ঝোলার থেকে যামিনী একটা ছোট্টমতো পুতুল বের করল। চেহারাটা বিজ্ঞাপনে ছাপানো পুতুলটার মতই বদখত। ওই রকমই কালো ভুত, ওই রকমই কাঠিকাঠি হাত-পা। পুতুলটা দেখিয়ে যামিনী বলল, 'কারো নাম নিয়ে মন্ত্র পড়ে যদি এই পুতুলে সুঁচ ফুটিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আর দেখতে হবে না। একেবারে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ! টার্গেট ২৪ ঘন্টার মধ্যে কুপোকাত হয়ে যাবে।' এই বলে যামিনী খিক খিক করে অদ্ভুতভাবে হাসল। প্রচ্ছন্নভাবে যে আমাকেই ভয় দেখাতে চাইল তা তার পরের কথাতেই বোঝা গেল। হাসি থামিয়ে সহসা গম্ভীর হয়ে সে বলল, 'এই পুতুল বড় সাংঘাতিক। হাইতি থেকে ইম্পোর্টেড। আপনার শত্রুর হাতেও এই পুতুল থাকতে পারে। আপনার নাম নিয়ে যদি সে এইভাবে এই পুতুলে সুঁচ ফোঁটায়, তাহলে কী হতে পারে ভাবতে পারছেন কি? ভুডুর থেকে সাবধানে থাকবেন।" সেই থেকেই আতঙ্কে আছি। মনে হচ্ছে যামিনী এবার প্রতিশোধ নেবেই।'
'আপনার সাথে যামিনীমোহনবাবুর শত্রুতার কারণ কী শুধু হিঞ্চেপুকুরের ওই সম্পত্তি নিয়ে, না কি অন্য কোনও...'
'অন্য কোনও কারণ নেই। শুধুমাত্র পৈত্রিক সম্পত্তিই যত সমস্যার মূল। বিবাদটা শুরু হয়েছিল আমার ঠাকুরদা আর ওর ঠাকুরদার মধ্যে। ওঁরা ছিলেন দুইভাই। পূর্বপাকিস্তানের সম্পত্তি বেচে হিঞ্চেপুকুরে এসে তাঁরা বসবাস শুরু করেছিলেন। ব্যবসা নিয়ে মনকষাকষি হবার পর যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরে। এমন কী মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। ঠাকুর্দাদের দেহরক্ষার পর বাবা-জ্যাঠা-কাকাদের হাত ধরে বিবাদ শেষে আদালতে গড়ায়। আদালতের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে আর কী বলব! জীবদ্দশায় তাঁরা মামলার শেষ দেখে যেতে পারেননি। অতঃপর মামলা চালানোর দায় পড়ল আমার উপর। যামিনী ছিল একটা অকালকুষ্মাণ্ড। সারাক্ষণ কবিতা নিয়ে পড়ে থাকত। চাকরি-বাকরি পেল না। বিষয়বুদ্ধিও ছিল কম। প্রাইভেট টিউশানি করে কোনও মতে ওর দিন গুজরান হত। আমার তো সংসার আছে, আমাকে আমার পরিবারের জন্যে তো গোছাতেই হবে। যামিনী সম্পত্তি বাঁচানোর জন্যে কোর্ট-কাছারিতে ছোটাছুটি করল না, সেই দোষ কি আমার?'
'কোর্ট আপনার ফেভারে রায় দিল, তাই তো?'
'হ্যাঁ। কোর্টের রায় পেয়ে সম্পত্তিটা এক প্রোমোটারকে বেচে দিলাম। সেই টাকাতেই ব্যবসা ফেঁদে বসলাম। ভাগ্যের জোরে ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেল। আর প্রোমোটারের তাড়া খেয়ে যামিনী হল দেশান্তরী।'
'যদি লোকটা সত্যিই যামিনীমোহন হয়, তাহলে তো চিন্তার কথা!' বললাম আমি, 'সেক্ষেত্রে আপনার সিকিউরিটি বাড়ানো দরকার। শুধু দারোয়ানে চলবে না। পেশাদার সিকিউরিটি গার্ড দরকার। কোনও এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করব কি?'
'আরে, দূর!' কাষ্ঠ হাসি হেসে হরমোহনবাবু বললেন, 'এই সব সুপারন্যাচারাল ব্যাপারে সিকিউরিটি গার্ড কী করবে? তন্ত্র-মন্ত্রের এন্টিডোট হল তন্ত্র-মন্ত্র। জাঁদরেল কোনও তান্ত্রিকের সন্ধান পাও কি না দেখো!'
আমি বাস্তববাদী মানুষ। ভুত-ভগবান-শয়তান কোনও কিছুতেই বিশ্বাস নেই। ভুডু পুতুল দিয়ে শত্রু নিকেশের কালাজাদু যে পুরোপুরি বুজরুকি সেই ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তবু সেই কথা হরমোহনবাবুকে মুখ ফুটে বলতে পারিনি। বয়স্ক মানুষ। এত দিনের লালিত বিশ্বাসে আঘাত দিলে অপমানিত বোধ করতে পারেন। রুষ্টও হতে পারেন। তাঁর কুসংস্কার নিয়ে তিনি থাকুন, আগ বাড়িয়ে আমি কেন অপ্রিয় হতে যাব? এই কথা ভেবে আমি আর কথা বাড়াইনি। তবে অযৌক্তিক ভাবনাও যে, অনেক সময় অশ্চর্যজনকভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে কিছুদিন পরই তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
বিশ্বামিত্র শাস্ত্রী সত্যিই যামিনীমোহন কি না, আর তিনি  সত্যিই হরমোহনবাবুর কোনও ক্ষতি করতে চান কি না, তা নিয়ে আমারও কিছু আগ্রহ কম ছিল না। তাই চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের উদ্দেশ্যে একদিন ভদ্রলোকের চেম্বারে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। ভুডু পুতুলও দেখলাম। কিঞ্চিত পড়াশুনাও করলাম এই বিষয়ে। জানতে পারলাম, ভুডু মানেই অশুভ কিছু নয়। ভুডু আসলে নানা আদিম প্রথা ও সংস্কারে আচ্ছন্ন এক একেশ্বরবাদী ধর্ম। ধারণা করা হয়, এর উৎপত্তি হাইতিতে। তবে চর্চা বেশি আফ্রিকায়। "ভুডু" শব্দের মানে "ঈশ্বর" কিংবা বিরাট আত্মা। শব্দটার উদ্ভাবক হল 'ফন' জাতি। ভুডুবিদ্যায় বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করে, ভুডু বিদ্যার সাহায্যে কবরে সমাধিস্থ মৃতদের জ্যান্ত করে কৃতদাসের মত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বিশ্বামিত্র শাস্ত্রী বলেছিলেন, 'হেলিও সিলমেনের নাম শুনেছেন? বিখ্যাত তান্ত্রিক। ২০১৪ সালে ফুটবল বিশ্বকাপে ব্রাজিলের পার্ফর্মেন্সটা একবার মনে করুন। সিলমেন না থাকলে ব্যাটারা সেমিফাইনালেও উঠতে পারত কি না সন্দেহ! ব্রাজিলের প্রত্যেক খেলার আগেই কালাজাদু করত লোকটা। প্রতিপক্ষ দলের প্রতিক হিসেবে ভুডু পুতুলকে চোখ বেঁধে হেঁট মুণ্ড উর্দ্ধপাদ করে ফেলে রাখত। তাতেই ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ দলের প্লেয়াররা দম হারাত। পড়েননি? নিউজপেপারে তো এই খবর বেরিয়েছিল!'
'তাহলে সেমিফাইনালে ব্রাজিল উৎরাল না কেন?' সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম আমি, 'যতদূর মনে পড়ছে জার্মানিই জিতেছিল।'
'আসলে সিলমান অতিরিক্ত ঢাক বাজিয়ে ফেলেছিল।' বিশ্বামিত্র শাস্ত্রী জবাব দিয়েছিলেন, 'জার্মানির বিরুদ্ধে ব্যাটা যে কালাজাদু প্রয়োগ করবে, তা সে সাংবাদিকদের সামনে প্রকাশ করে দিয়েছিল। ওটা ওর করা উচিত হয়নি। আরে বাবা, বাপেরও বাপ থাকে। এই দেশে কী ব্রাজিল বিরোধীর অভাব আছে? ওরা আমাকে এসে এমনভাবে ধরল যে, না বলতে পারলাম না। আমিও পালটা দিলাম। কোয়ার্টার ফাইনালের দিন ব্রাজিলের ফরোয়ার্ড নেইমারের নাম করে কলকাতায় বসে ভুডু পুতুলে সুঁচ ফোঁটালাম, আর ওদিকে খেলার মাঠে নেইমার হাড় ভেঙে বিশ্বকাপ থেকে "নেই" হয়ে গেল! আল্টিমেট ব্রাজিল জার্মানির কাছে ১--৭ গোলে হারল।' খ্যাক খ্যাক শব্দে হেসেছিলেন বিশ্বামিত্র শাস্ত্রী।
জাঁদরেল তান্ত্রিক খুঁজে আনব, সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে হরমোহনবাবুর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম সেদিন। কিন্তু তান্ত্রিক আমার আর খুঁজতে হল না। হরমোহনবাবু আমার উপর ভরসা না করে, পরের দিনই সক্কাল সক্কাল আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, 'বুঝলে হে, সাবধানের মার নেই। তুমি বরং আমার গুরুদেবকে নিয়ে এসো। এই বিপদ থেকে তিনি নিশ্চয়ই আমাকে উদ্ধার করতে পারবেন!'
অগত্যা সেদিনই আমাকে ছুটতে হল বক্রেশ্বরে। ওখানেই হরমোহনবাবুর গুরুদেব জটেশ্বর গোস্বামীর আশ্রম। গুরুদেব সব শুনে পেল্লায় এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, 'সবই তো বুঝলাম বাবাজীবন, কিন্তু আমি তো যেতে পারব না! ইদানীং বাতের ব্যাথাটা খুব বেড়েছে। আমার বদলে আমার পুত্র গোপেশ্বর যাবে।'
কথাটা শুনে আশ্বস্ত হতে পারলাম না। নাকের বদলে নরুন নিয়ে ফিরলে হরমোহনবাবু কি খুশি হবেন? মনে তো হয় না। আমি সেই কথা জানাতেই গুরুদেব বললেন, 'চিন্তা কোরো না। আমার মধ্যে যে ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে, তা আমার পুত্রের মধ্যেও বর্তমান। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি আমার বংশধরদের মধ্যে আগামী হাজার বছরেও ঐশ্বরিক ক্ষমতার ঘাটতি হবে না।'
নাছোড়বান্দার মত তবু বললাম, 'আপনি গেলেই ভাল হয় গোসাঁইজী। কলকাতার সেরা ডাক্তারকে দিয়ে আপনার আরথ্রাইটিসের চিকিৎসা করানোর সুযোগ দিয়ে আমাদের ধন্য করুন।'
তোষামোদে চিঁড়ে ভিজল না। গোস্বামীজী বললেন, 'চিকিৎসা তো কম করানো হয়নি বৎস! কিছুতেই কিছু হয়নি! সবই শ্রীহরির লীলা! তিনি কী পরীক্ষা নিচ্ছেন কে জানে! এবার আবার আমার এক ভক্ত আকুপাংচারের ব্যবস্থা করেছে। টেবিলে দেখো কত ওষুধপত্র এনে জড়ো করেছে ব্যাটা! এখন দেখা যাক কী হয়! কার মুক্তি কোথায় কে বলতে পারে? আকুপাংচারেই রোগ সারবে হয়ত-বা! সবই যখন হল, তখন ওটাই-বা বাদ থাকে কেন?'
মরিয়া হয়ে শেষে বললাম, 'হরমোহনবাবু আপনার অপেক্ষায় হা-পিত্যেস করে বসে আছেন। বাড়িতে আপনার পায়ের ধুলো পড়লে তিনি বড় নিশ্চিন্ত হবেন।'
গোসাঁইজী বললেন, 'ভক্তের ডাকে সাড়া দিতে পারছি না, এতে আমার দুঃখও কম নয় বাবা! গোপেশ্বরকেই নিয়ে যাও। তাতেও কাজ হবে। আমি আর কয় দিন? আমি বৈকুণ্ঠধামে যাবার পর ভক্তদের আশীর্বাদ দেবার জন্যে তো ওই গোপেশ্বরকেই আশ্রমের দায়িত্ব নিতে হবে। এখন থেকেই অভ্যাসটা হোক। আর, আমি তো আছিই। গোপেশ্বরের ক্ষমতা নিয়ে যাতে হরমোহনের কোনও সন্দেহ না হয়, তাই আমি বরং ফোনেই ওর সাথে কথা বলে নেব।'
অগত্যা ওই কথাই ফাইনাল হল। জটেশ্বরের প্রক্সি হিসেবে গোপেশ্বরকে নিয়েই কলকাতায় ফিরে এলাম।
হরমোহনবাবু স্বস্তি পেলেন না বটে, তবে গুরুভাইয়ের খাতির-যত্নের কোনও ত্রুটি রাখলেন না। গোপেশ্বরকেও ভালই বোলচাল ঝাড়তে দেখা গেল! বাপের থেকে উপযুক্ত ট্রেনিং-ই নিয়েছে বটে! গোপেশ্বরকে তো হাড়ে হাড়ে চিনি! ঐশ্বরিক ক্ষমতা না ছাই! ব্যাটা চারবারের চেষ্টাতেও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরতে না পেরে বাপের থেকে টাকা নিয়ে তামাকের ব্যবসা শুরু করেছিল। বাপেরও বলিহারি! ভক্তদের গাঁটকাটা পয়সা অপাত্রে দান করেছিলেন। ব্যবসা করতে গেলে যে বুদ্ধির দরকার তা গোপেশ্বরের ছিল না। বন্ধুর উপর নির্ভর করে শেষ পর্যন্ত ব্যাটা ডুবেছিল। তামাকের আড়ালে সেই বন্ধু যে গাঁজার কারবার খুলে রেখেছিল, তা প্রকাশ পেল যখন আশ্রমে পুলিশের বুটের ধুলো পড়ল। তবে গোপেশ্বরকে জেলে যেতে হয়নি। থানার আই. সি.'র শ্বসুরমশাই জটেশ্বরের ভক্ত। তাঁর একটা ফোনেই নিশ্চিত হাজতবাসের থেকে রক্ষা পেয়েছিল গোপেশ্বর। বাপের ঐশ্বরিক ক্ষমতার যে কী মহিমা, গোপেশ্বর সেই সময় তা বুঝতে পেরেছিল। অন্য ধান্দা বাদ দিয়ে বাপের গুরুগিরির ব্যবসাতেই মনোনিবেশ করেছিল অবশেষে। আমি ওকে কমিক রিলিফ ছাড়া আর কিছুই মনে করি না।
গোপেশ্বর হরমোহনবাবুকে অনেক ভুজং ভাজং দিয়ে যজ্ঞের নামে বিস্তর দক্ষিণা হাতিয়ে হরমোহনবাবুর বাম বাজুতে একটা মাদুলি বেঁধে দিয়ে বলল, 'এই মাদুলি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ কোনও অপশক্তি তোমার ক্ষতি করতে পারবে না হরমোহন। মাদুলি যত্ন করে রেখ।'
কিন্তু মাদুলি বিপদ ঠেকাতে পারল না।
হরমোহনবাবুর বাড়িতে দিন পাঁচেক চর্ব-চোষ্য-লেজ্য-পেয় সাঁটিয়ে গোপেশ্বর বিদায় নেবার পরদিনই কাকভোরে হরমোহনবাবুর জরুরি তলব এল। হরমোহনবাবুর ঘরে ঢুকে দেখতে পেলাম তিনি নিজের খাটে শুয়ে ছটফট করছেন। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই পীড়িত কণ্ঠে বললেন তিনি, 'হাতে যন্ত্রণা! যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি।'
ডান হাতের কনুইয়ের খানিকটা উপরের অংশ দেখলাম লাল হয়ে রয়েছে। বললাম, 'গুতো খেয়েছেন, না কি কিছু কামড়েছে?'
'না হে ওসব কিছু নয়,' কঁকিয়ে উঠলেন হরমোহনবাবু, 'যামিনীমোহনের প্রতিশোধ শুরু হয়ে গেছে। ওই দিকে দেখো।'
তাঁর বাম হাতের ইশারা অনুসারে টেবিলের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতেই জিনিসটা নজরে এল। একটা ভুডু পুতুল ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। পুতুলটার ডান হাতের কনুয়ের উপরের অংশে একটা সুঁচ ফোটানো আছে।
'গতকাল রাতে ঘরে ঢুকেই ওটাকে দেখেছি।' হরমোহনবাবু হাহাকার করে উঠলেন, 'ভেবেছিলাম, হাতে মাদুলি আছে, পুতুল আমার কী ক্ষতি করবে? কিন্তু এখন দেখছি গোপেশ্বরের মাদুলির উপর ভরসা করা-ই আমার ভুল হয়েছে।'
হরমোহনবাবু রাগ করে মাদুলিটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, 'রাতের বেলা হঠাৎ মনে হল হাতে যেন কী ফুটল। ঘুমে এতটাই আচ্ছন্ন ছিলাম, যে চোখ পর্যন্ত মেলতে পারলাম না। সাধারণত আমার ঘুম কখনো এত গাঢ় হয় না। গতকাল কী যে হল! এখন যামিনীর ক্ষমতা বুঝতে পারছ তো!'
যন্ত্রণাটা শুধু হাতেই সীমাবদ্ধ থাকল না। শ্বাসকষ্ট, বমিবমিভাব, চুলকানি, দাস্ত-- প্রভৃতি নানান ধরেণের উপসর্গ দেখা দিল। ফলে ডাক্তার ডাকতে হল।
পারিবারিক ডাক্তার মৃদুলবাবু হরমোহনবাবুকে পরীক্ষা করে বললেন, 'হাতে কিছু কামড়েছে বলে মনে হচ্ছে। ওষুধ দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে।'
এই ধাক্কা সামলে ওঠার কিছুদিন পরই আক্রমনটা আবার এল। এবার হরমোহনবাবু ভুডু পুতুল খুঁজে পেলেন তার গাড়ির পিছনের সিটের উপর। পুতুলের বামহাতের কনুইয়ের উপরে সুঁচ ফোটানো। পুতুলটা পেয়ে এবার হরমোহনবাবু যার-পর-নাই ঘাবড়ে গেলেন। গুরুদেব জটেশ্বর গোস্বামীকে ফোন করলেন। ফোন ধরল গোপেশ্বর। কিন্তু কথা বলতে বলতেই ফোন কেটে গেল। তারপর "নট রিচেবল"। মাদুলির ব্যর্থতার অভিযোগের সম্মুখীন হতে অনিহার কারণেই বোধহয় ফোনকে এরোপ্লেন মডে করে দিয়েছিল গোপেশ্বর। বিরক্ত হয়ে হরমোহনবাবু বললেন, 'দুচ্ছাই! এবার মনে হচ্ছে নতুন গুরু ধরতে হবে! কাজের সময় যে গুরুকে না পাওয়া যায়, সেই গুরু রেখে লাভ কী?'
পরদিন হরমোহনবাবু বাম হাতের ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে জাগলেন। এবারও প্রতিক্রিয়া হল আগেরবারের মতই।
সুস্থ হবার পর কিছু দিন বিরতির পর আক্রমণ করা হল আবার। তারও কিছুদিন পর আবারও। আক্রমণ হল দুই পা লক্ষ্য করে। এর ফলে শারিরীক ক্ষতি যতটা হল, মানসিকভাবে হরমোহনবাবু বিপর্যস্ত হলেন আরো বেশি। ব্যবসার দিকে আর মন রইল না। বাড়ি ছেড়ে বেরনো প্রায় ছেড়েই দিলেন। ভুগে ভুগে মেজাজটাও হয়ে উঠল তিরিক্ষে।
আমি বললাম, 'বিশ্বামিত্র শাস্ত্রীর বিরুদ্ধে থানায় ডায়রি করব?'
'পুলিসকে কী বলবে?' বিরক্ত মুখে খেঁকিয়ে উঠলেন হরমোহনবাবু, 'এক জ্যোতিষী জাদু-টোনা করে আমাকে খুন করতে চাইছে! এই কথাই বলবে তো? কেস নেবে ওরা? যত্তসব! দিন দিন তোমার বুদ্ধি-সুদ্ধি কি লোপ পাচ্ছে?'
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
মৃদুল ডাক্তার বললেন, 'উনি মানসিকভাবে একদমই ভেঙে পড়েছেন। ওনাকে একটু চেঞ্জে নিয়ে যেতে পারেন। নতুন পরিবেশ পেলে উপকার হতে পারে। কন্টিনিউয়াস মেন্টাল প্রেসারের মধ্যে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পারে।'
কিন্তু হরমোহনবাবু রাজি হলেন না। বললেন, 'যেখানেই যাই ভুডুর হাত থেকে আমার নিস্তার নেই। এখন মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গোনা ছাড়া আর কিছু করার নেই।'
হরমোহনবাবুর আশংকা-ই সত্যি হল অবশেষে। একদিন ভোর বেলাতে পরিত্রাহি চিৎকার ভেসে এল হরমোহনবাবুর ঘর থেকে। আমরা ছুটে গেলাম তাঁর ঘরে। দেখলাম-- হরমোহনবাবুর নিস্পন্দ শরীর খাটের উপর পড়ে আছে। তাঁর বিস্ফারিত চোখ মশারীর উপরে রাখা ভুডু পুতুলের উপর নিবদ্ধ। পুতুলটার বুকের বামধার ঘেঁসে সুঁচ ফোটানো।
মৃদুল ডাক্তার হরমোহনবাবুর মৃতদেহ পরীক্ষা করে বললেন, 'হার্ট এটাক। মনে হয় অতিরিক্ত ভয়-ই এর কারণ।'

***

অফিসে বসে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছিলাম, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। কল গ্রহণ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল, 'হ্যালো, সৃজা হোসিয়ারি? আমি বরেন মোহন্ত বলছি। সামনে ইলেকশন। প্রচারের জন্যে এবার অন্ততঃ লাখ দুয়েক টি শার্ট বানাতে হবে। হরমোহনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই। একটু ব্যবস্থা করে দিন না!'
টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা ভুডু পুতুলগুলোর উপর নজর বুলিয়ে নিয়ে বললাম, 'হরমোহনবাবু পরলোকগমন করেছেন। এখন সৃজা হোসিয়ারির মালিক, এই অধমই। আমার সংস্থাকে সুযোগ দেবার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।'

***
কী? ভাবছেন তো, আমি চাকর থেকে কী করে মালিক হয়ে গেলাম? আমার স্ত্রীর সম্পত্তি তো আমারও সম্পত্তি, তাই না? আইনত এখনও আমি মালিক হইনি বটে, তবে মালিকের দায়িত্ব আমাকেই সামলাতে হয়। হরমোহনবাবুর একমাত্র কন্যাই যে আমার স্ত্রী, ইচ্ছে করেই আপনাদের আগে তা বলিনি। একটা চমক দিতে চেয়েছিলাম। আমার স্ত্রী সৃজা জন্মান্ধ। ব্যবসা সামলানোর মতো ক্ষমতা তার নেই। তাই সেই দায়িত্ব আমিই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছি। যে ভাবে হরমোহনবাবুকে সরিয়ে দিয়েছি, তেমনি তার মেয়েকেও সরিয়ে দিলেই আমি সৃজা হোসিয়ারির পূর্ণ-- এক ও অদ্বিতীয়ম মালিক হয়ে যাব। এই যাঃ কথায় কথায় গোপন কথাটা মুখ থেকে বেরিয়েই গেল! তবে আপনারা আমার কী-ই-বা করবেন? এই গল্পের সব চরিত্রের নামই গোপনীয়তার স্বার্থে পরিবর্তিত। আমি মোটেই কাঁচা খেলয়াড় নই। তবে এতটা ধৈর্য নিয়ে যখন আমার এই সাহিত্যকীর্তি পড়লেন-ই, তখন কী করে হরমোহনবাবুর ভবলীলা সাঙ্গ করলাম, সে-টুকুও জানুন। আমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারবেন না।
হরমোহনবাবু ভুডু পুতুলগুলোকে পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিলেন। কিন্তু নিজের শিল্পকর্মকে নষ্ট করতে কি আর মন চায়? ওগুলো এখন আমার অফিসের টেবিলে সাজানো থাকে। ওই পুতুলগুলোর দৌলতেই তো আমার ভাগ্য পরিবর্তন, ওদের কী আর পোড়াতে পারি? আগেই বলেছি, ভুডু পুতুল নিয়ে আমি একটা সময় উৎসাহী হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু মন্ত্র দিয়ে ওদের চালানো তো আর আমার কম্ম নয়! কেউ তা আদৌ পারে বলে বিশ্বাসও করি না। তাই পুতুলে সুঁচ ফুটিয়ে আমাকেই সেগুলোকে এমনভাবে রাখতে হত, যাতে হরমোহনবাবুর দৃষ্টি না এড়ায়। সুযোগ বুঝে হরমোহনবাবুর খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিতাম, যাতে মৌমাছির বিষ ইনজেক্ট করার সময় তাঁর ঘুম না ভেঙে যায়। মৌমাছির বিষে যে হরমোহনবাবুর এলার্জি আছে তা বুঝেছিলাম প্রথমবার প্রয়োগ করার পরেই। আমার ভাগ্য খুবই ভাল, এলার্জি থাকার ফলে আমার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল! অবশ্য এলার্জি না থাকলেও ফলাফল একই রকম হতো। সেক্ষেত্রে বুকে সুঁচ ফোটানো পুতুল দেখাবার আগে হয়ত আরো কিছু পুতুল খরচ করতে হত। পুতুল তন্ত্রের আইডিয়ার জন্যে আমি মনে মনে যেমন জ্যোতিষাচার্য বিশ্বামিত্র শাস্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ, তেমনি কৃতজ্ঞ গুরুদেব জটেশ্বর গোস্বামীর প্রতিও। মৌমাছির বিষ যে আমার কার্য সিদ্ধির উপাদান হতে পারে, তা বুঝেছিলাম জটেশ্বরের আশ্রমে গিয়েই। আকুপাংচারের নামে আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় জটেশ্বরের যে ট্রিটমেন্ট চলছিল তার পোষাকি নাম "বি ভেনোম ট্রিটমেন্ট"। সবার দৃষ্টি বাঁচিয়ে জটেশ্বরের ওষুধের মধ্যে থেকে এক শিশি বি-ভেনোম তুলে নিয়েছিলাম। অবশ্য ওখান থেকে ওটা না সংগ্রহ করতে পারলেও কোনও সমস্যা হত না। ওই জিনিস এখন অনলাইন শপেও পাওয়া যায়। গুগলে গিয়ে সার্চ করেই দেখুন না!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.