মোল্লাবাদ ও বাবাসাহেব আম্বেদকর
মুসলিম ধর্মই একমাত্র মানবতার সনদ। শুধু ধর্মপ্রাণ মুসলমানই নয়, এই রকম ধারণায় আক্রান্ত তথাকথিত শিক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই। এই বিষয়ে শিক্ষিত মুসলমানদের গোঁড়ামি নিরক্ষর মুসলমানদের থেকে অনেক বেশি। মুসলমান সমাজে শিশুকাল থেকেই শেখানো হয়, বিধর্মীরা মালাউন (অভিশপ্ত)— ওরা দোজখের আগুনে পুড়বে; ওদের সঙ্গে বন্ধুতা কোরো না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবু এখন অনেক মুসলমান ধর্মাবলম্বীই দলিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছেন। মুসলমানদের দলিত বলা যায় কি না, সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, মুসলমানেরা দলিত আন্দোলন করছেন, অথচ ধর্মের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যটাকে ছাড়ছেন না। সেক্ষেত্রে আম্বেদকরবাদের উপর তাদের কতটা শ্রদ্ধা আছে, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কোনও মনুবাদী কিংবা মোল্লাবাদী সহিহ্ আম্বেদকরবাদী হতে পারেন না। কারণ, আম্বেদকরবাদী হলে মনুবাদ কিংবা মোল্লাবাদের উপর বিশ্বাস উবে যাওয়ার কথা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেই দেখতে পাচ্ছি, দলিত আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হয়েও কেউ কেউ বলছেন, "কোরানে কোনও ভুল নেই।" এমন ধারণা পোষণ করেও যারা আম্বেদকরবাদী আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, তারা কি ইসলাম সম্পর্কে আম্বেদকরের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে সচেতন? মনে হয় না। আম্বেদকরের মতবাদ না জেনে কী করে দলিত আন্দোলন করা যায়? আসুন এক পলকে দেখি ইসলাম ধর্মের প্রতি বাবাসাহেব আম্বেদকরের মনভাব কেমন ছিল।
PAKISTAN OR THE PARTITION OF INDIA বইতে বাবাসাহেব লিখেছেন:
“মুসলিম সমাজে উপস্থিত সামাজিক ব্যাধি যথেষ্ট বেদনা দায়ক। কিন্তু তার থেকেও আফশোষের যে, এই সমস্যার মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে সমাজসংস্কারের জন্য সংগঠিত কোনও আন্দোলনও নেই। হিন্দুসমাজে সামাজিক ব্যাধি আছে। লক্ষ্যনীয় যে, হিন্দু সমাজের অনেকেই এই বিষয়ে সচেতন এবং কেউ কেউ সেই ব্যাধির উপশমের জন্য সক্রিয়ভাবে আন্দোলনরত। অন্য দিকে, মুসলমানেরা সামাজিক ব্যাধির উপস্থিতিই অনুভব করে না। ফলস্বরূপ, ব্যাধি উপশমের জন্য উদ্বিগ্নতাও তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। বস্তুতপক্ষে চিরাচরিত রীতিনীতির কোনও রূপ পরিবর্তনকে তারা সর্বোতভাবে বিরোধিতা করে। ১৯৩০ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভায় উত্থিত “বাল্য-বিবাহ বিল”-এ মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৪ থেকে বাড়িয়ে ১৮ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, মুসলিম কানুনের পরিপন্থী হওয়ার কারণে মুসলমানেরা এই আইনের বিরোধিতা করেছিল। এই বিল পাশের প্রতিটা স্তরে শুধু তারা বাধাই দেয়নি, যখন এই বিল আইনে পরিণত হল, তখন তারা এই আইনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করল। সৌভাগ্যবশত, মুসলমানদের এই আন্দোলন বিস্তার লাভ না করে কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। তাদের সেই আন্দোলন সমাজসংস্কারে তাদের তীব্র অনীহা-ই প্রমাণ করে।
এখন প্রশ্ন, মুসলমানেরা সমাজ সংস্কারের প্রসঙ্গে বিরোধিতা করে কেন?
প্রচলিত উত্তর হল, সমস্ত বিশ্বেই মুসলমানেরা প্রগতিশীল নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গী ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তাদের কর্মকাণ্ডের প্রথম স্ফুরণের পর সন্দেহাতীতভাবে বিস্ময়াবহ এক বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তির দিকে চালিত হয়ে মুসলমানেরা হঠাৎ করেই অদ্ভুত এক অসাড় পরিস্থিতে পতিত হয়েছে, যার থেকে তারা বোধহয় কখনোই জাগবে না। যারা মুসলমানদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা এই অসাড় পরিস্থিতির কারণ হিসেবে মুসলমানদের মৌলিক ধারণাকে দায়ি করছেন, যে ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা বিশ্বাস করে, ইসলাম একটা বিশ্ব-ধর্ম, যা যে-কোনও সময় ও পরিস্থিতিতেই সকল মানুষের ক্ষেত্রে উপযুক্ত।”
(The existence of these evils among the Muslims is distressing enough. But far more distressing is the fact that there is no organized movement of social reform among the Musalmans of India on a scale sufficient to bring about their eradication. The Hindus have their social evils. But there is this relieving feature about them—namely, that some of them are conscious of their existence and a few of them are actively agitating for their removal. The Muslims, on the other hand, do not realize that they are evils and consequently do not agitate for their removal. Indeed, they oppose any change in their existing practices. It is noteworthy that the "Muslims opposed the Child-Marriage Bill brought in the Central Assembly in 1930, whereby the age for marriage of a girl was raised to 14 and of a boy to 18 on the ground that it was opposed to the Muslim canon law. Not only did they oppose the bill at every stage but that when it became law they started a campaign of Civil Disobedience against that Act. Fortunately the Civil Disobedience campaign of the Muslims against the Act did not swell and was submerged in the Congress Civil Disobedience campaign which synchronized with it. But the campaign only proves how strongly the Muslims are opposed to social reform.
The question may be asked why are the Muslims opposed to social reform ?
The usual answer given is that the Muslims all over the world are an unprogressive people. This view no doubt accords with the facts of history. After the first spurts of their activity the scale of which was undoubtedly stupendous leading to the foundations of vast empires—the Muslims suddenly fell into a strange condition of torpor, from which they never seem to have become awake. The cause assigned for this torpor by those, who have made a study of their condition, is said to be the fundamental assumption made by all Muslims that Islam is a world religion, suitable for all people, for all times and for all conditions. --- (PAKISTAN OR THE PARTITION OF INDIA,Chapter X : Social stagnation:
By Dr. B.R. Ambedkar).
ইসলামে কী কী "Evil" আছে বাবাসাহেব ঐ বইতেই স্পষ্ট করে বলেছেন। তার মধ্যে চাইল্ড ম্যারেজের বিষয়ে যেমন বলা আছে, তেমনি আছে পর্দাপ্রথা, যৌনদাসী প্রথা, চার বিয়ে প্রথা নিয়ে সমালোচনাও। অভিন্ন দেওয়ানী বিধি যদি আম্বেদকর না চাইতেন তাহলে Child-Marriage Bill1930-এর প্রসঙ্গ তিনি তাঁর লেখায় তুলতেন না।
বস্তুতপক্ষে মনুবাদ যেমন ক্ষতিকর। মোল্লাবাদও তাই। মোল্লাবাদ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মোল্লাবাদ তিন তালাক টিকিয়ে রাখতে চায়। মুসলমান পুরুষদের বহুবিবাহকে সমর্থন করে। আবার পোলিও টীকাকরণেরও বিরোধীতা করে। সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতীয় মুসলমান নারীরা তিন তালাক প্রথার অবসান চান। কিন্তু মোল্লাবাদীরা আর তার সমর্থকেরা মুসলমান নারীদের দাবিকে দাবিয়ে রেখেছে। স্বয়ং আম্বেদকরই বলেছেন মুসলমান নারীরা সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত। সমাজের সমস্ত অংশ যদি উন্নতি না করতে পারে তাহলে সমাজের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। সেই সময়ে আম্বেদকর যা বুঝেছিলেন আধুনিক আম্বেদকরবাদীরা মুসলমান তোষণের অছিলায় সে সব বিলকুল ভুলে গেছেন। অভিন্ন দেওয়ানী বিধি চাইলেই RSS কিংবা বিজেপি বলে দেগে দেওয়াটা একটা ক্ষতিকর মানসিক রোগ। আম্বেদকর অভিন্ন দেওয়ানী বিধি চাইতেন। ইসলাম ধর্মের সংস্কার চাইতেন। তাহলে আম্বেদকরকেও RSS বলা যায়, কী বলেন?
দলিত আন্দোলনে মুসলমানেরা সামিল হচ্ছেন। খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু মুসলমান আর মোল্লাবাদী এক নয়। প্রগতিশীল মানুষ দলের সম্পদ। ধর্মান্ধ মানুষ আন্দোলনের পক্ষে বিপজ্জনক। মুসলমানদের মধ্যে যারা প্রকৃতই ধর্মনিরপেক্ষ ও শোধনবাদী তাঁরা দলিত আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু কিছু মোল্লাবাদী, যারা নিজেদের সমাজের সংস্কার করার পক্ষপাতী নন, অথচ দলিত-দরদী সেজেছেন, তাদের চালিত করছে কোনও সংকীর্ণ রাজনৈতিক অভিষন্ধি চরিতার্থ করার তাগিদ, এই রকম সন্দেহ নেহাত অমূলক নয়। দলিত নেতৃত্বের কাছে অনুরোধ, সমাজ সংস্কারে যাঁদের এলার্জি তাঁদের প্রগতিশীল তকমা দিয়ে দলিত আন্দোলনের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করবেন না। দলে ফিল্টার লাগান। এখনো সময় আছে। রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সমাজ সংস্কারের জন্য গণ-আন্দোলন। অন্যথায় আন্দোলন বিপথগামী হতে বাধ্য!!!
কোন মন্তব্য নেই